বর্ষায় এলোমেলো আমি

আজ সারাদিন গুমোট মেঘলা। ঝির-ঝির বৃষ্টি… কখনো গুড় গুড় করে মেঘের ডেকে যাওয়া। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা। ভয়ংকর শব্দে কানে তালা লাগার মতো কিছু মেঘের গর্জন… আর এই মূহুর্তে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। তীব্র বৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে মুখ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আমার বিছানাটা জানালার পাশে। সেই জানালা দিয়ে ভেসে আসছে মাটির সোঁদা গন্ধ। বৃষ্টি শুরু হলে এইরকম গন্ধ পাওয়া যায়– মনটা কেন যেন আনচান করে ওঠে…
একটা গল্পের বই পড়ছিলাম। ট্র্যাজেডি– শেষে মূল চরিত্র মারা গেলো। একটা পোস্ট পড়লাম ব্লগে। আরো খারাপ হয়ে গেলো মন। এই খারাপের অনুভূতিতে কেমন যেন কষ্ট মেশানো… এইটার কোন উপশম আমার জানা নেই। বরং নিজেকে খুব একা বলে মনে হচ্ছে। আসলে মনে হওয়ার কিছু নেই; আমি প্রকৃতই একা।এইরকম বর্ষণঘণ দিনে সেই একাকীত্বকে প্রকট করে খুঁজে পাই। এই খারাপ লাগাটাকে কমাতেও মন চাইছে না… এখন প্রায় সব সময়-ই এ রকম হয়…
এরকম ব্যাপারটাকে আমি নাম দিয়েছি “দুঃখ-বিলাস”। যখন মন খারাপ হয়, সেইটা আরো বাড়িয়ে দিতে মনে চায় কখনও কখনও… কেমন যেন নেশার মত লাগে !! থাক না, আর ভালো হওয়ার কী দরকার...??


নিঃসীম পৃথিবীতে কথা বলার মানুষ পাই না বলেই হয়ত কলম ধরলে কলম আমার চিন্তার আগেই এগিয়ে চলে… মনের জানালা গুলো খুলে যায়, আর আমি নিজের ভেতরের বদ্ধ হয়ে থাকা চিন্তাদের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি দেই। এতক্ষণ, এতদিন যেই অনুভূতিরা গুমরে মরছিল, তাদের আর্তনাদ সইতে না পারলে লিখতে বসে পড়ি। হতে পারি আমি একজন মানুষ হিসেবে খুব সামান্য, কিন্তু একটু প্রশান্তি কে না চায়! আর সেই প্রশান্তি লেখার মাধ্যমেই কিছুটা পাই...
ব্লগ না থাকলে হয়তো আমি আমার "হলুদ রংয়ের ডায়েরিটা" নিয়ে বসে পড়তাম। যদিও ডায়েরিটাতে লিখি না আজ প্রায় ২বছর, তবুও আজ লিখতাম...সত্যি লিখতাম।  উন্মোচিত করতাম মনের ভেতর জমে থাকা কথা গুলোকে…
২২ টি বর্ষা অতিক্রান্ত হয়েছে এই জীবনে। আর একটি মাস পরে পা রাখবো ২২-এ। ক্ষুদ্র এই সময়ের ব্যাপ্তিতে যাদের একটু আপন করে পেয়েছিলাম, তারাই চলে গেছে দূরে। যাকে ভালোবেসে কাছে টেনেছি, সে-ই আমায় ফেলে গেছে দুঃসহ বেদনা দিয়ে। ভুল বুঝেছে, দিয়েছে মিথ্যে অপবাদ। বারংবার নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি– আমাকে কেন কেউ ভালবাসে না? নাকি বাসে, আমিই কি টের পাইনা...?? কেন আমাকে কেউ কখনো আপন বন্ধু ভাবে না...?? নাকি আমি বন্ধু হওয়ার মতো না...? ? নাকি আমার বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা নেই...??

কৈশোরে কিছু বন্ধুদের পেয়েছিলাম আপন করে– তারা আজ জীবনকে সফল করার তাগিদে আমার থেকে দূরে…আমি আবার সে-ই একাকীত্বে। সেই আমি, সেই বৃষ্টিস্নাত দিন। শুধু কিছু স্মৃতি আমার সংগী।আমি ওই স্মৃতিদেরই বুকে জড়িয়ে ধরে আছি। নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বুঝতে চাই কবে আমার মুক্তি মিলবে এই ব্যস্ত জীবনের শিকল থেকে!

এই রকম দিনে বড় স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে মনটা। কত জনকে যে মনে পড়ে! কত কিছু যে মনে পড়ে! কেমন যেন একটা শূণ্যতা ভর করে বুকের মাঝে… এই রকমটা মনে হয় কম-বেশি সবারই হয়…

পরিষ্কার মনে আছে– ছেলেবেলায় এইরকম আবহাওয়া পেলে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম, মুখ ভার করে জানালায় গিয়ে দাঁড়াতাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কত-শত ভাবতাম! এলোমেলো, আবোল-তাবোল… খুব ভালো লাগত। স্বপ্ন দেখতাম– নিষ্কলুষ, অকলংক, পবিত্র সেই সব কল্পনা! তবু কত স্বপ্ন বাস্তব হলো! কত নতুন দুঃস্বপ্ন জীবনকে এলোমেলো করে দিলো!!

আমি চেয়ে চেয়ে দেখি! দেখি সবাই কিসের পেছনে যেন ছুটছে… ক্যারিয়ার, চাকুরি, উন্নতি… আরো কত রকমের স-ব শব্দ ভেসে আসে প্রতিনিয়ত কানের পাশে! আমি ওদের মত পারিনা। এতটা চিন্তিত হতে আমার ইচ্ছে করেনা। আমিতো আমার কাজ করছিই… তাহলে কেন প্রতি মূহুর্তে এত সচেতন হতে হবে জীবিকার চিন্তায়?
আমি হয়তো ওতটা বাস্তববাদী নই। আর তাই হয়ত আমি জীবন-যুদ্ধ থেকে ছিটকে পড়তে পারি… আর তাই হয়ত আমার দিকে কেউ চেয়ে দেখে না… আমি কারও পাশে থাকলে কারো ভাললাগবে, তার সময় ভালো কাটবে, এটা হয়তো কেউ বিশ্বাস করে না… — এইরকম কত-শত চিন্তাই তো মাথায় আসে!!
আমি শুধু ভেবেই চলি। ভেবে চলি আমায় একদিন চলে যেতে হবে এই প্রকৃতি ছেড়ে, যেতে হবে এই পৃথিবী ছেড়ে… তখন আমি আর এইভাবে বৃষ্টির পানিতে মুখ ভেজাতে পারব না… আমি আর মাটির সোঁদা গন্ধ নিতে পারব না বুক ভরে… আমি তখন আর পারব না বর্ষায় নগ্ন কদমের দুলে যাওয়া দেখতে… পারব না বৃষ্টিতে মাঠে গিয়ে শুয়ে গিয়ে প্রকৃতির সাথে মিশে যাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে…
চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করে… নাআআআ...। তখন আমি কী করে থাকব...!
নাহ, এইতো বেশ আছি! কষ্টের মাঝে আবদ্ধ হয়ে, স্মৃতি গুলো নিয়ে...।।  কত না সুখী এই আমি! কত না সংগী এই আমারই– এই আকাশ, এই বাতাস, এই বৃষ্টি, এই স্নিগ্ধতা…সঙ্গী যে শুধু মানুষ হবে তাতো নয়...।।
হঠাৎ মুখে গানের ওই চরণগুলো জায়গা করে নেয়–
যদি এমনি করেই যায় চলে দিন,
যাক না ……