এক জীবনে অনেক প্রশ্নই এড়িয়ে যাওয়া হয়, অনেক কথাই না বলা রয়ে যায়। অনেক বিদায়ের আগেই জানান দেয়া থাকে না। অনেক আবেগই অপ্রকাশ্য থেকে যায়, অনেক মেসেজই আনসিন থেকে যায়। অনেক বারই কাউকে ডাকতে গিয়ে মুখ দিয়ে কথা বের হয় না, শুধু দূর থেকে অপলক চেয়ে থাকতে হয়। অনেক কিছুই ফেরত দেয়া হয় না আর, আবার সব ফেরত দিলেও কী জানি হয়তো কিছু রয়ে যায়। হয়তো এই কিছুটা "মন"... 

অনেক বারই মোবাইলের স্ক্রিনে কারো নাম দেখে দীর্ঘঃশ্বাস লুকোনো যায় না। মোবাইল এর স্কীনে প্রিয় মানুষ টির নাম কখনো ভেসেও উঠে না, হয়তো সে তার প্রিয় মানুষ নিয়ে ব্যাস্ত। অমুক গানের সুর শুনে অনেক কথাই মনে পড়ে, একা একা হাসি পায়, চোখে পানি চলে আসে। তার কথা মনে করিয়ে দেয়। হাঁটতে, চলতে, ফিরতে ট্রেনে-বাসে রাস্তায় প্রায়ই কিছু চেহারা পরিচিত মনে হয়। খুব মিল থাকে কারো একজন মানুষের সাথে। একটু পরপরই আড়চোখে দেখে নেয়া হয় 'এই সে নয় তো...!'এমন হাজারো অনেক কিছু আমাদের 'একান্ত আপন কিছু' এই সমস্ত কথা, সব আবেগ, সব স্মৃতি মনের মধ্যে তাদের জায়গাটা ঠিকই আলাদা করে থাকে, আমরা যত্নে আগলে থাকে। সেখানে তাদের রাজ্য, আর কারো আনাগোনা নেই সেখানে, অসতীত্ব নেই।

উদাস চেহারা দেখে চারপাশের প্রশ্ন যখন নাড়িয়ে দিবে- তখন খুব স্বাভাবিক মুখ করে আমরা বলবো, "কই, কিছু ভাবছি না তো....!!" বাইরের জগতে খোলসে ঢাকা শামুক হয়ে থাকা শিখে যাই আমরা, কিন্তু মনে মনে হয়তো ঠিকই অঞ্জন দত্তের গানটা বেজে উঠবে- "একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে মনে পড়ে যাবে সব কথা......কথা দিয়ে কথাটা না রাখার ফেলে আসা চিনচিনে ব্যথা...।।

কেউই জীবন থেকে পুরোপুরি চলে যায় না। প্রিয় গানটার সুরের মাঝে চুপচাপ লুকিয়ে থাকে সে তাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। শুধু তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। শুধু মানুষটাই জীবন থেকে হারিয়ে যায়। মানুষটার স্মৃতি হারিয়ে যায় না, চ্যাট লিস্টে সবার উপরে যে নামটা থাকতো একসময় সে ব্লকলিস্টে বা কোন লিস্টেই নেই বা থাকে না। এখন তার নামটা সার্চ বক্সে টাইপ করলেও আর আসে না। হাজার হাজার একই নামের আইডি আসে কিন্তু সেই আইডিটা আর আসে না। খুব করে খুঁজলে ছবিবিহীন কালো রঙের নামটুকু জানিয়ে দেয় সবকিছু, জানিয়ে দেয় সে আজ অনেক দূরে। অনেক অনেক নতুন মানুষের ভীড়ে চাপা পড়ে যায় পুরনো কেউ নামের মানুষটা...। সেই চাপা পড়া ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে ঐ মানুষটাই কোন কোন রাতে ফেরত চলে আসে। পূর্বাভাস ছাড়াই বুকের ভেতরটায় তখন তুমুল ঝড় বইতে থাকে। অতীত নামের দমকা হাওয়া এসে মূহুর্তেই ওলট-পালট করে দেয় সবকিছু... । শুরু হয়ে যায় বুকের বামপাশের চিনচিনে ব্যাথাটা। মাঝরাতের অন্ধকার রুমে বসে নিজের অজান্তেই চোখের জল চলে আসে হঠাৎ করেই চলে আসে। 

পুরনো কোন গল্প ই আসলে মুছে যায় না। গল্প গল্পের জায়গাতেই থাকে, একটা সময় শুধু তোমাকেই গল্পের চরিত্র থেকে মুছে দেয়া হয় খুব যত্ন করে। সময়, ভালোবাসা গুলো কখনোই বদলায় না, বদলে যায় মানুষটা।

আমরা সবাই জানি রাত জাগা অনেক ক্ষতিকর। কিন্তু তবুও আমরা রাত জাগি। কারন কিছু মোমেন্ট আমাদেরকে ঘুমাতে দেয়না, সব সময় অচেনা একটা কষ্ট এসে ভর করে বুকের বাম পাশে। তখন আর ঘুম আসেনা। মানুষ বদলায় না, বদলে যায় তার মনের চাওয়া পাওয়া গুলো। খুব চেনা, খুব আপন মানুষটা কিন্তু ঠিকই রয়ে যায়। মাঝে মাঝে চোখের সামনে দেখে ভীষণ মায়া হয়... মুঠো করা হাত গুলো ছুটে যেতে চায় তার হাত গুলো ধরার জন্য। হাত ধরার অদম্য ইচ্ছে টুকু মনে জন্মানোর সাথে সাথেই মাটিচাপা দিতে হয়। সবই আগের মতোই থাকে শুধু মনের দরজার সামনে চোখের জলের স্বচ্ছ কালিতে লেখা "প্রবেশ নিষেধ" নামক একটা অদৃশ্য সাইনবোর্ড নীরবে চিৎকার করে বলে-
"সবকিছুই আগের মতই আছে, শুধু অধিকারটুকু নেই...।"

"যে মন খারাপের কোন কারণ নেই, সেই মন খারাপ লুকিয়ে রাখাই বোধহয় ভালো। বেশিরভাগ মানুষই মন খারাপ দেখে যে 'কেন?' - প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে, সেই প্রশ্নের উত্তর আমার নিজেরও জানা নেই !! কোন কোন মন খারাপের সময় কারো সাথে কোন প্রকার বাক্য বিনিময় করতে ইচ্ছা করে না । চুপচাপ থাকতে দেখে অনেক মানুষ অনেক কিছু ভাবতে থাকে। আর আমি ভাবি, আমার কোথাও হারিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এমন কোথাও হারিয়ে যাওয়া প্রয়োজন যেখানকার ঠিকানা পৃথিবীর কেউ জানে না, কেউ না !!

সারাদিন হাসিমুখে থাকা মানুষটিও কাঁদতে জানে। তারও ইচ্ছে করে কেউ তার চোখের জলটুকু খুব যত্নে মুছে নিক। সবসময় "ভাল আছি" বলা মানুষটিরও কিছু মন খারাপের গল্প থাকে। তারও ইচ্ছে করে কেউ তার সেই গল্প গুলো মন দিয়ে শুনুক, একটু বুঝুক।

রোজ রোজ "ভেঙে পরবে না, কোনো আঘাতই জীবনকে থামিয়ে দিতে পারে না, তুমি নিজেই তোমার ভাল থাকার উপায়" এসব বলে সাহস দেয়া মানুষটিও কখনো কখনো প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতায় ভোগে। তারও ইচ্ছে করে কেউ একজন নিঃশব্দে তার কাঁধে হাত রেখে বলুক "আমি আছি তো"। প্রেম, ভালবাসার তীব্র বিরোধী মানুষটিরও মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় কেউ তার হাতটি শক্ত করে ধরে অন্তত একটিবার বলুক "ভালবাসি"। শাসন করুক, আগলে রাখুক।

অনেক হাসির পিছনেই চোখের জল থাকে, অনেক ভাল থাকার পিছনেই ভীষণ রকমের মন খারাপের গল্প থাকে। শুধু অন্যরা বুঝতে পারেনা। হয়তো মানুষ গুলোই বুঝতে দেয় না। "বাইরে থেকে দেখে কারো জীবন সম্পর্কে আন্দাজ করাটা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। কিন্তু এই অসম্ভব কাজটাই আমরা প্রতিনিয়ত করতে থাকি। হাসিখুশি মানুষটাকে দেখে ভাবি, তার জীবনে কোন সমস্যাই নেই। কেউ একটু দুঃখের গান শুনলে ভাবি, তার জীবনে অনেক কষ্ট। অথচ ব্যাপারটা এরকম নাও হতে পারে !!

একজনের গল্প বলি। দেশের টপ ভার্সিটিতে পড়া শুনা করে, Top Multinational Company-তে Job- একদম পারফেক্ট লাইফ...।। অথচ কেউ আন্দাজও করতে পারবে না, মানুষটা কি ভয়াবহ ডিপ্রেসনে ভুগচ্ছে । এই মানুষটিকে প্রায়ই সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হয় কিন্তু তবু ঠিক হচ্ছে না। কেউ শুনলে বিশ্বাস করতে চায় না, ব্যাঙ্গ করে বলে "ওর আবার কিসের ডিপ্রেসন !!??" ওর মত জীবন পেলে আমি স্বর্গে থাকতাম। কেউ আবার বলে, আরেহ ঢং। সব আছে, তাও ডিপ্রেসড...! এগুলো ভাব,  বিলাসিতা !! দিন শেষে ঐ মানুষটিই শুধু জানে তার মনে কি চলতেছে। 

আমরা অনেক অল্পতেই জাজমেন্ট দিয়ে ফেলি। বাইরে থেকে দেখেই কোন কিছু সম্পর্কে একটা কথা বলে বসি। বলার আগে ভাবি না যে, আমি যেভাবে চিন্তা করছি ব্যাপারটা অন্যভাবেও তো হতে পারে...!! একটা মানুষ তার মাথার ভেতর, মনের ভেতর কেমন অনুভব করছে আপনি আমি তার এক ভাগও বুঝতে পারবো না, হাজার চেষ্টা করলেও না... !!

আমার কাছে যার জীবনটা স্বপ্নের মত লাগে, তার দুঃস্বপ্ন গুলোর এক বিন্দুও হয়তো আমি দেখি নি। কিন্তু আমি ভেবে নিয়েছি তার জীবনটা সপ্নের মতো। আমার জীবনটা যার কাছে রূপকথার গল্পের মত সুন্দর লাগে, সে হয়তো আমার ভিতরের শূন্যতা, বাস্তবতার ছিটেফোঁটাও টের পায় নি বা কখনো অনুভব করে নি !! জীবনটা এমনই, কেউ এক মূহুর্ত সময় নিয়ে চোখে চোখ রেখে কাউকে বুঝতে চায় না কিন্তু তাকে নিয়ে অনেক কিছুই বলা হয়ে যায়। 

এই পৃথিবীতে ঠিকানাবিহীন হারিয়ে যাওয়ার কিংবা লুকিয়ে যাওয়ার কোন জায়গা নেই। দিনশেষে ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় আমাদের একটা ঠিকানাতে ফেরত আসতে হয়। সেই ঠিকানাতে নিজে লুকিয়ে থাকা যায় না। তাই নিজের অনুভূতি গুলো যত্ন করে সূক্ষ্ম অভিনয়ের নীল খামে ভরে, কালো ডায়েরীতে লুকিয়ে রেখে বেঁচে থাকতে হয় !!" তখন হয়তো নিজে বেঁচে থাকা যায় কিন্তু অনুভুতি গুলোকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না...

MARI themes

Powered by Blogger.